কোন জিলায় কি আছে পর্ব ১ ।।। ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলীং টু ঢাকা (Virtual Traveling to Dhaka)
কোন জিলায় কি আছে পর্ব ১ ।।। ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলীং টু ঢাকা
আমার ঢাকা, প্রাণের ঢাকা, আমাদের ঢাকা। শতবর্ষী এই ঢাকার বুকে আজও টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শতবর্ষী অনেক পুরাকীর্তি যার বেশীরভাগই কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং নগরায়নের জোয়ারে এগুলোর খোঁজ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আর তাই আহালান ব্রডকাস্ট চ্যানেলের এবারের আয়োজন ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলীং টু ঢাকা ।
ঢাকা এবং ঢাকা শহরের আশেপাশের বেশকিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে ধারাভাস্য ও টেক্স থাকবে, যাতে করে আগত দিনে যে কেউ চাইলে এই ধারাভাস্য ও টেক্স হতে একসাথে অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের খোঁজ পেয়ে যেতে পারে সহজেই।
আসুন শুরু করা যাক, যেহেতু আমার বাসবাস পুরাতন ঢাকায়, তাই পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থান দিয়েই শুরু করি। সর্বপ্রথম প্রাচীন মসজিদ, খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ।
খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদঃধারণা করা হয়ে থাকে খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ ১৭০৪ -১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে খান মোহাম্মদ মৃধা ভূমি থেকে ৫ মিটারের বেশী উঁচুতে প্রায় ৩৮ মিটার বাই ২৯ মিটার আয়তনের এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মসজিদ কম্পাউন্ডে মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে হাতের বাম দিকে রয়েছে মূল মসজিদ কাঠামো। ডানদিকে বিস্তৃত বাগান এবং এই বাগানের উত্তরপূর্ব কোনে একটি পরিত্যাক্ত কুয়া রয়েছে, একসময় সেই কুয়ার পানি দিয়ে মুসল্লিদের অজু এবং অন্যান্য ব্যবহার্য পানি সরবরাহ করা হত। মূল মসজিদের কাঠামো তিন গুম্বজ বিশিষ্ট এবং এর চারিদিকে ছোট ছোট প্রায় বিশ-পঁচিশটি মিনারের মত কাঠামো রয়েছে। মসজিদটি বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে থাকলেও নামাজের জন্য তা স্থানীয়দের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছ।
এবার আসুন একটু এগিয়ে যাই লালবাগের কেল্লার দিকে। খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ হতে ২০০ গজ পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেই লালবাগ কেল্লা। এই কেল্লা নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই।
এবার লালবাগ কেল্লা হতে একটু উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে চলে আসি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দিকে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরঃ এটি ঢাকা শহরের অন্যতম প্রধান একটি মন্দির যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান তথা উপাসনালয়। ঢাকেশ্বরী মন্দির ঢাকা শহরের পলাশী ব্যারাক এলাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহের দক্ষিণে ঢাকেশ্বরী রোডে অবস্থিত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণশৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সাথে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মূল মন্দির প্রাঙ্গনের বাইরে মহানগর পুজামণ্ডপ অবস্থিত। এখানে যেখানে দুর্গা পুজার স্থায়ী বেদী রয়েছে। মূল মন্দির এলাকার ভবনগুলি উজ্জ্বল হলুদাভ ও লাল বর্ণের। মূল মন্দির প্রাঙ্গনের উত্তর পশ্চিম কোণে রয়েছে চারটি শিব মন্দির। মূল মন্দিরটি পূর্বাংশে অবস্থিত। এখানে দেবী দুর্গার একটি ধাতু-নির্মিত প্রতিমা রয়েছে।
এখন চলুন আরও পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে বকশীবাজার এলাকা পার হয়ে চলে যায় হোসেনী দালান।
হোসেনী দালানঃ হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকা এলাকায় অবস্থিত একটি শিয়া উপাসনালয় এবং কবরস্থান। বিকল্প উচ্চারণ হুস্নী দালান এবং ইমারতের গায়ে শিলালিপিতে ফারসী ভাষায় লিখিত কবিতা অনুসারে উচ্চারণ হোসায়নি দালান। এটি মোগল শাসনামলে ১৭শ শতকে নির্মিত হয়। ইমারতটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পৌত্র হোসেন (রাঃ)-এর কারবালার প্রান্তরে শাহাদৎবরণের স্মরণে নির্মিত। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো এ স্থাপনা মোগল আমলের ঐতিহ্যের নিদর্শন। মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমামবাড়ার দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তাঁর এক নৌ-সেনাপতি সৈয়দ মীর মোরাদ কর্তৃক হিজরী ১০৫২ সনে (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত হয়।তিনি প্রথমে তাজিয়া কোণা নির্মাণ করেন, ইমামবাড়া তারই পরিবর্ধিত রূপ। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটি নকল নয়। শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে নির্মাতা হিসেবে মীর মুরাদের নাম। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, 'মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন। ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুন:নির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১ তে পুনর্বার দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পুর্রহোসেনী দালান ইমামবাড়ার সংস্কারসাধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। হোসেনী দালানের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃদির পুকুর। এর উত্তরাংশে শিয়া বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান অবস্থিত। দালানটি সাদা বর্ণের, এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারূকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরেও সুদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। ইরান সরকারের উদ্যাগে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালানের ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। ইরান সরকার এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে। সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়। এখন চলুন আরও পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে বকশীবাজার এলাকা পার হয়ে চলে যায় হোসেনী দালান।
এবার চলুন পুরাতন ঢাকার চকবাজারে, প্রথমেই খোঁজ করি ছোট কাটারার।
ছোট কাটারাঃ ছোট কাটারা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি একটি ইমারত। আনুমানিক ১৬৬৩ - ১৬৬৪ সালের দিকে এ ইমারতটির নির্মান কাজ শুরু হয় এবং তা ১৬৭১সালে শেষ হয়েছিল। এটির অবস্থান ছিল বড় কাটারার পূর্বদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ইমারতটি দেখতে অনেকটা বড় কাটারার মত হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটারার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটারা। তবে ইংরেজ আমলে এতে বেশ কিছু সংযোজন করা হয়েছিল। শায়েস্তা খানের আমলে ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল সরাইখানা বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। কোম্পানি আমলে ১৮১৬ সালে মিশনারি লিওনারদ ছোট কাটরায় খুলেছিলেন ঢাকার প্রথম ইংরাজি স্কুল। ১৮৫৭ সালে, এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকার প্রথম নরমাল স্কুল। উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোট কাটরা ছিল নবাব পরিবারের দখলে। এবং তাতে তখন ' কয়লা ও চুণার কারখানার কাজ' চলত। ছোট কাটরার সাথে বিবি চম্পার স্মৃতিসৌধ অবস্থিত ছিল। , এক গম্বুজ, চার কোণা, প্রতিপাশে ২৪ ফুট দীর্ঘ ছিল স্মৃতিসৌধটি। তায়েশ লিখেছেন, 'পাদ্রী শেফার্ড ওটা ধ্বংস করে দিয়েছেন।' শেফার্ড বোধহয় কবরটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। বিবি চম্পা কে ছিলেন তা সঠিক জানা যায় নি। তবে কারো মতে তিনি শায়েস্তা খাঁর মেয়ে। বর্তমানে ছোট কাটারা বলতে কিছুই বাকি নেই শুধু একটি ভাঙা ইমারত ছাড়া। যা শুধু বিশাল তোড়নের মতন সরু গোলির উপর দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে অসংখ্য দোকান এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে যে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে মুঘল আমলের এমন একটি স্থাপত্য ছিল।
তো আজ এই পর্যন্ত থাক, আগামী পর্বে আবার বেড়িয়ে পড়া যাবে এই ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলীং এর উদ্দেশ্যে, শুরু করব পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বড় কাটরা দিয়ে। এইফাঁকে খোঁজ করুন, বড় কাটরা কি, কোথায়, কেন বিখ্যাত? ততক্ষণের জন্য বিদায় হে বন্ধু।
Comments
Post a Comment